মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গুন্ডেতে ইতিহাস বিকৃতি : বাংলাদেশ সরকারের দাবিকে পাত্তা দিল না নির্মাতারা

ডেস্ক রিপোর্ট
বলিউডের হিন্দি ছবি ‘গুন্ডে’তে যেভাবে ১৯৭১-এর যুদ্ধকে বর্ণনা করা হয়েছে, তার জন্য ছবিটির নির্মাতা যশরাজ ফিল্মস দুঃখ প্রকাশ করলেও ছবিটির প্রদর্শন বাতিল করার বা তাতে পরিবর্তন আনার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। মুম্বাই থেকে যশরাজ ফিল্মস কর্তৃপক্ষ বিবিসিকে একথা নিশ্চিত করেছেন।
বিবিসি জানায়, তবে ভারতের চিত্র পরিচালকরা কেউ কেউ যেমন বলছেন এ ছবিতে সত্যিই ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, তেমনি ইতিহাসবিদরা আবার অনেকে মনে করছেন ‘একটা সামান্য ব্যাপারে’ বাংলাদেশ ‘একটু বেশিই’ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
এর আগে ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘গুন্ডে’র প্রদর্শনী বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এমন তথ্য জানানো হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
পাশাপাশি এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের পর ভারত সরকারের ফিল্ম সার্টিফিকেশন কেন্দ্রীয় বোর্ড কর্তৃক অনুমতি প্রদান করায় ভারতীয় সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদও জানানো হয়েছে

বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গুণ্ডে’ চলচ্চিত্র নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ, সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রতিক্রিয়া সরকারে দৃষ্টিগোচর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে কাজ শুরু করে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। পাশাপাশি ভারতীয় সেন্সর বোর্ড এ চলচ্চিত্রটিকে ছাড়পত্র প্রদান করায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তার গভীর পরিতাপ ও দুঃখ প্রকাশ করেছে।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকার পক্ষ থেকে দ্রুত ‘গুন্ডে’ চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনী বন্ধ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে।
এ অবস্থায় ভারত সরকারকে ‘গুণ্ডে’ চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছে ঢাকা।
১৫২ মিনিটের এ ছবিটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫০ কোটি রুপি। প্রযোজনা করেছেন আদিত্য চোপড়া।
বাংলাদেশে সমালোচনা
১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিণামেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম—গুন্ডে ছায়াছবিতে এই বিতর্কিত মন্তব্যকে ঘিরেই গত কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে তোলপাড় চলছে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তীব্র প্রতিবাদের পর ঢাকায় এ ইস্যুতে বিক্ষোভ সমাবেশও হয়েছে। প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিমধ্যেই ভারতকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গুণ্ডে’র ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতো বড়মাপের আত্মসমর্পণ আর হয়নি। তারপরই জন্ম হয় নতুন এক দেশের, বাংলাদেশ যার নাম।
নির্মাতাদের বক্তব্য
ছবিটির নির্মাতা যশরাজ ফিল্মস দিন-কয়েক আগেই তাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছে, ‘এ বিষয়ে অনেক বাংলাদেশী ভাইয়েরা তাদের উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন, এবং গুন্ডেতে যেভাবে গল্প বলা হয়েছে তা যদি তাদের অমর্যাদা করে থাকে বা আঘাত দিয়ে থাকে তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’
সংস্থার একজন মুখপাত্র বিবিসি-কে জানান, এর বাইরে তাদের আর আপাতত যোগ করার কিছু নেই।
কিন্তু ভারত ও বিদেশের হাজার হাজার সিনেমা হলে ছবিটি এখন চলছে। ফলে তার প্রদর্শন বাতিল করা বা ছবির প্রিন্টে এখন কোনো রদবদল করা যে অসম্ভব সেটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন তিনি।
ভারতের প্রথম সারির চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর মতে, সিনেমায় এ ধরনের বেহিসেবি মন্তব্য করে গুন্ডের নির্মাতারা চরম দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
দাশগুপ্তের কথায়, ‘যারাই ছবিটি বানিয়ে থাকুন, তারা চরম অশিক্ষিত বলতেই হবে। বিন্দুমাত্র ইতিহাস জ্ঞান নেই তাদের, অথচ এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে ছবি বানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রতিবাদ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।্থ
ভারতীয় সেন্সরবোর্ড কীভাবে ছবিটির সার্টিফিকেট দিল, তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।
বর্ষীয়ান এই চিত্রপরিচালক আরও বলছিলেন, ‘ছবি আপনি যে কোনো বিষয় নিয়েই বানাতে পারেন, সেই স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করার স্বাধীনতা আপনার নেই, আর যখন সে ইতিহাস খুব দূরেরও নয়।’
তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমকালীন ইতিহাসের অধ্যাপক ড: শান্তনু চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভারতের তৈরি বিভিন্ন সিনেমার কাহিনী বা সংলাপ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিক্ষোভ কিন্তু নতুন ঘটনা নয়। অতীতে ‘তেরে বিন লাদেন’, ‘বিশ্বরূপম’ বা ‘বর্ডার’ ছবি নিয়েও প্রতিবেশী দেশগুলোতে সমস্যা হয়েছিল।
বিশেষ করে তিনি উল্লেখ করছিলেন ‘চাঁদনিচক টু চায়না’ ছবি নিয়ে বিতর্কের কথা, যে ছবিতে ভারতকে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে উল্লেখ করার পর নেপালে তুমুল বিক্ষোভ হয়েছিল। সে দেশে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ছবিটির প্রদর্শন।
ড: শান্তনু চক্রবর্তী তাই এক্ষেত্রেও মনে করছেন, গুন্ডেকে নিয়ে বাংলাদেশ যে প্রতিবাদ দেখাচ্ছে তারও একটা সঙ্গত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে।
ভারত সরকার অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে গুন্ডে বিতর্ক নিয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।
সাউথ ব্লকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকারের চিঠিটি ভালো করে খুঁটিয়ে পড়ার পরেই তারা প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবেন।
‘গুণ্ডে’ ছবির কাহিনী
বলিউডের ‘গুণ্ডে’ ছবিটি ১৯৭১ সালের পটভূমিতে নির্মিত হয়েছে। এ ছবিতে ১৯১৭ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
ভালোবাসা দিবসে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। ‘গুণ্ডে’ ছবিটি পরিচালনা করেছেন আলি আব্বাস জাফর।
কিন্তু মুক্তির পরপরই ছবির কাহিনী নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি প্রতিবাদের ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার এবং বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েবসাইটে।
অভিযোগ উঠে ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়।
বিভিন্ন সংগঠনের অভিযোগের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সমাবেশ।
এতে ‘গুন্ডে’র কাহিনীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ শহীদ এবং বাঙালি জাতিকে অপমানিত করার প্রতিবাদে অবিলম্বে ‘গুন্ডে’ প্রদর্শন বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।
এ যুদ্ধে ভারত জয়ী হয় বলে তুলে ধরা হয়েছে এবং ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে ভারত এই যুদ্ধে জয়ী হয় ও এর ফলে ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়!
ছবির শুরুর দৃশ্যে দেখানো হয়, ভারতীয় যোদ্ধাদের সামনে আত্মসমর্পণ করছেন পাকিস্তানি সেনারা। আর জন্ম হচ্ছে বাংলাদেশের। পেছনে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর পোস্টার। উদ্বাস্তু শিবিরের সামনে দিয়ে রুটি ছুড়তে ছুড়তে চলেছে ত্রাণের গাড়ি, আর কাদামাটি থেকে তা কুড়িয়ে খাচ্ছে অসহায় মানুষ।
‘গুন্ডে’ ছবিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখানো হলেও কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়নি।
যশরাজ ফিল্মসের ক্ষমা প্রার্থনা
যশরাজ ফিল্মসের অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় ক্ষমা চেয়ে লেখা এক বার্তায় বলা হয়েছে, ‘প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের ছবিতে যেভাবে গল্প তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অনেক ভাই তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। ছবিটির কাহিনী ও গল্প পুরোপুরি কাল্পনিক। কোনো জাতি, সমাজের বিশেষ কোনো গোত্র কিংবা কোনো ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের অভিপ্রায় আমাদের ছিল না। তারপরও বাংলাদেশী ভাইরা যদি আমাদের কাজ দেখে আহত হন কিংবা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করেন তাহলে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি আমরা।’
ফেসবুক পাতায় আরও বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। এটা কখনোই ভোলার নয়। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘যাই হোক, ‘গুন্ডে’ ছবিতে কোনোভাবেই বাংলাদেশীদের মহান আত্মত্যাগের বিষয়টিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়নি। আর ইতিহাস বিকৃতির তো প্রশ্নই ওঠে না। এর কাহিনীতে কেবল দেখানো হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক পরিবার ও মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য হতে হয়েছিল। ছবিতে এমনই একটি পরিবারের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।’
যশরাজ ফিল্মস বলেছে, ‘গুন্ডে’ ছবিতে দুটি অনাথ ছেলের গল্প বলা হয়েছে। তাদের নামের পাশে শরণার্থী তকমা এঁটে দেয়া হয়েছিল। সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। স্বাভাবিক জীবন-যাপনের সুযোগও তাদের ছিল না। এসব কারণে একটা সময়ে তারা পথভ্রষ্ট হয়। কাল্পনিক এই গল্পের কারণে কারও অনুভূতিতে যদি আঘাত লেগে থাকে তবে তার দায়ভার পুরোটাই আমরা নিচ্ছি। আমাদের অসাবধানতার কারণেই এমনটা হয়েছে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, কারও মনে আঘাত দেয়ার অভিপ্রায় আমাদের ছিল না। তারপরও কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন তবে আবারও আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি আমরা।


কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন