শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

নজরুল যেখানে অনন্য

নজরুল যেখানে অনন্য

হাসান শরীফ
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শনিবার, ৯:১৫

বাংলা সাহিত্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি বিস্ময়কর নাম। তার বিদ্রোহে বাংলা সাহিত্য চিরদিনের মতো বদলে যাওয়ার বিপ্লব ঘটে গেছে। অনেকেই তাঁর এই ভূমিকা স্বীকার করে নিয়েছেন। এখানে আরেক দিকপাল স্বীকৃতি তুলে ধরা হচ্ছে। তিনি হলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন। তিনি তাঁর ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায় (পৃষ্ঠা ১৫০-১৫১) কাজী নজরুল সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, এখানে তা তুলে ধরা হলো-
‘নজরুলের জীবন লইয়া অনেক চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি। এই লোকটি আশ্চর্য লোকরঞ্জনের মতা লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। যখনই যেখানে গিয়াছেন, যশ অর্থ সম্মান আপনা হইতেই আসিয়া তাঁহার পদতলে লুটাইয়া পড়িয়াছে। রবীন্দ্রনাথ হইতে সত্যেন্দ্রনাথ পর্যন্ত- কেহই কবিতা রচনা করিয়া সেকালে অর্থ-উপার্জন করিতে পারেন নাই। রবীন্দ্রনাথের বহু পুস্তকের তখন দ্বিতীয় সংস্করণ হইত না। মাসিক পত্রিকার সম্পাদক কবিদের কবিতার জন্য অর্থ তো দিতেনই না- যে সংখ্যায় কবির কবিতা ছাপা হইত, সেই সংখ্যাটি পর্যন্ত কবিকে কিনিয়া লইতে হইত। নজরুলই বোধ হয় বাংলার প্রথম কবি, যিনি কবিতা লিখিয়া মাসিক পত্রিকা হইতেও প্রচুর অর্থ উপার্জন করিয়াছেন।
আগে গ্রামোফোনের জন্য যাঁহারা গান রচনা করিতেন, গ্রামোফোন কোম্পানীর নিকট হইতে তাঁহাদের খুব কম লোকই রচনার মূল্য আদায় করিতে পারিতেন। নজরুল গ্রামোফোনের গান রচনা করিয়া শুধু নিজের গানের জন্যই পারিশ্রমিক আদায় করিলেন না, তাঁহার আগমনের পর হইতে সকল লেখকই রচনার জন্য উপযুক্ত মূল্য পাইতে লাগিলেন। নজরুল প্রমাণ করিলেন, গানের রেকর্ড যে বেশী বিক্রি হয়- সে শুধু গায়কদের সুকণ্ঠের জন্যই নয়, সুন্দর রচনার সহিত সুন্দর সুরের সমাবেশ রেকর্ড বিক্রয় বাড়াইয়া দেয়। নজরুলের আগমনের পর হইতে গ্রামোফোন-কোম্পানী আরও নূতন নূতন রচনাকারীর সন্ধানে ছুটিল, নূতন নূতন সুর-সংযোজনকারীর খোঁজে বাহির হইল। নজরুলের রচনা আর সুর লইয়া তাঁহারা বুঝিতে পারিল, সুন্দর কথার সঙ্গে সুন্দর সুরের সমাবেশ হইলে সেই গান বেশি লোকপ্রিয় হয়। গ্রামোফোন-কোম্পানীতে কাজ যে এত কথাকার আর এত সুরকার গুঞ্জরণ করিতেছেন, এ শুধু নজরুলের জন্য। একথা কি তাঁহারা কেহ আজ স্বীকার করিবেন?
একটি গান রচনা করা অনেক সময় একটি মহাকাব্য রচনার সমান। মহাকাব্যের লেখক সুবিস্তৃত কাহিনীর পটেেপর মধ্যে আপনার ভাব রূপায়িত করিবার অবসর পান। গানের লেখক মহাকাব্য রচনা করেন অতি-সংপ্তি কয়েকটি কথার ভিতর দিয়া। মহাকাব্যের পাঠক বার বার সেই কাব্য পাঠ করেন না; করিলেও সেই কাব্যের ত্র“টিবিচ্যুতি ও গুণের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই জন্য একটি ভাল গান রচনা করা প্রায় একটি মহাকাব্য রচনার মতই কঠিন। নজরুলের বেলায় দেখিয়াছি, গান রচনা তাঁহার পে কত সহজ ছিল। তিনি যেন গান রচনা করেন নাই, বালকের মত পুতুল লইয়া খেলা করিয়াছেন। সুরগুলি পাখির মত সহজেই তাঁহার কথঅর জালে আসিয়া আবদ্ধ হইয়াছে।’
ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা
এরশাদ : একজন সাপুড়ে রাজনীতিক!
ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা : ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রথমে নিজ নির্বাচনী এলাকা রংপুর সফরে এসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ বলেছেন, ‘আমি এখনো শৃংখলমুক্ত রাজনীতিবিদ নই, অতীতেও শৃংখলমুক্ত ছিলাম না; এখনো নই।’ এরশাদের এ বক্তব্য রংপুরের মানুষের মধ্যে বেশ হাসির খোরাক জুগিয়েছে। রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ আর দলনে যারা হাসতে ভুলে গিয়েছিলেন তারাও এরশাদের এ বক্তব্য শুনে না হেসে পারেননি। অনেকেই এধরনের হাসানোর খোরাকের যোগান দেয়ায় এরশাদের প্রশংসা করছেন।
এরশাদের রংপুর সফরের আগের দিন জাতীয় পার্টির জেলা কার্যালয়ের অনতিদূরে পায়রা চত্বরে দাঁড়িয়ে এক সরকারি চাকুরে রংপুরে জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এরশাদের রাজনৈতিক আচরণ হলো সাপুড়েদের মতোই। সাপুড়েরা যেমন সাপের খেলা দেখানোর সময় কথা দিয়ে মানুষ ভুলিয়ে-ভালিয়ে টাকা রোজগার করে; তেমনি এরশাদও কথার ছলনে রংপুরের মানুষকে ভোলাতে চেষ্টা করেন। আনপ্রেডিক্টেবল খ্যাত এরশাদ সকালে এক কথা আর বিকেলে আরেক কথা বলায় মানুষ তার কথা আস্থায় নেয় না। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং ৫ জানুয়ারীর জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে ভেল্কিবাজী করেছেন তার খেসারত তাকে দিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সিএমএইচ-এ থেকে তিনি কখনো দাবি করেন আমি আটক, আবার গলফও খেলেন নিয়মিত। তার দলের লোকজনই গলফ খেলার দৃশ্য মোবাইলে ধারন করে তা মিডিয়ায় সরবরাহ করেছে। সেই ব্যক্তিরাই এখনো তার রাজনৈতিক সঙ্গী। এরশাদ মুখে যাই বলুক মানুষ তাকে আস্থায় নেয় না। আলোচনায় যোগ দিয়ে একজন অধ্যাপক বললেন, ওই লোকের কাছে রংপুরের মানুষ যেন ভোট বন্ধক রেখেছে। আর উনি ইচ্ছামতো যেমন খুশি তেমন ভোট বিক্রী করছেন। রংপুরের মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে তিনি দুই ভাই, স্ত্রী, বোন, ভাতিজা, বোন জামাইকে এমপি, মন্ত্রী করেছেন। তিনি আর সে সুযোগ পাবেন না। উপজেলা নির্বাচনে এরশাদ টের পাবেন রংপুরের জনগণের কাছে তার অবস্থান কোথায়। তার ভেল্কিবাজীতে মানুষ আর ভুলবে না।
রংপুর শহরের পায়রা চত্বরে স্থানীয় কলেজের অধ্যাপকের ক্রোধের প্রতিফলন দেখা গেছে এবার উপজেলা নির্বাচনে। প্রথম দফায় ৯৭ উপজেলা নির্বাচনে ৯৬টির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ৪৩টি, আওয়ামী লীগ ৩৪টি, জামায়াত ১৩টিতে বিজয়ী হয়েছে। আর এরশাদের জাতীয় পার্টি মাত্র একটি উপজেলায় বিজয়ী হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান পদেও একই অবস্থা। ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ৩২ (পুরুষ) ৩৪ (নারী), আওয়ামী লীগ ২৪ (পুরুষ) ৩৪ (নারী), জামায়াত ২৩ (পুরুষ) ১০ (নারী), জাতীয় পার্টি ৩ (পুুরুষ) ১ (নারী) বিজয়ী হয়েছে। জামায়াত আর জাতীয় পার্টির ফলাফলের চিত্রই বলে দেয় দেশের রাজনীতিতে এরশাদের অবস্থান কোথায়।
রংপুরের কয়েকটি উপজেলার গ্রামগঞ্জ এবং জেলা শহরে ঘুরে কৃষক ক্ষেতমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন মত পথ ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যারা এরশাদকে নিয়ে এতোদিন গর্ব করতেন; তারাই দুঃখ করছেন; নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আফসোস করছেন। বিগত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এরশাদের মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেয়ার জন্য নিজেদের ধিক্কার দিচ্ছেন। গাইবান্ধার স্টেশন রোডে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী রওশন আলম আকন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজনীতিতে আদর্শ থাকে; থাকে নীতি নৈতিকতা। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলোর নেতাদের অনৈতিকতা করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলো এরশাদের মতো রঙ্গিন নেতারা ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ প্রবচন চালু করে মূল্যবোধের রাজনীতিতে শেষ পেরেক ঠুঁকে দিয়েছেন। নীতি নৈতিকতার চেয়ে ক্ষমতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় ওরা জনগণের সঙ্গে এমন আচরণ করছেন। রংপুরের মানুষের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে এরশাদ এতোদিন জনপ্রিয়তার পারদ উপরে উঠিয়েছেন; কিন্তু তার নীতিহীনতা আর জামা-কাপড় বদলের মতো ‘ক্ষণে ক্ষণে মত বদল’ রংপুরের মানুুষের ভুল ভেঙ্গে দিয়েছে। গাইবান্ধায় দেখা গেল বিগত জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পোস্টারে এরশাদের ছবিতে কে বা কারা কালি লেপ্টে দিয়েছে। জামায়াত অধ্যুষিত সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়ও একই চিত্র দেখা গেল। বেরসিকদের কেউ কেউ আবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও দলের চেয়ারম্যানের ছবিতে কালো কালি দিয়ে গোঁফ এঁকে দিয়েছেন। দৃষ্টিকটূ ওই পোস্টারগুলো বাতাসে উড়ছে পত্ পত্ করে।
তিস্তা স্টেশনে নেমে পিছনের পথে কিছুদূর এলেই তিস্তার চর। কাউনিয়া রেলওয়ে ব্রীজ আর অনতিদূরে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করা নতুন ব্রিজ। ব্রিজের নীচে পানি নেই। স্কুল আর মাদ্রাসার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কয়েকজন ছেলে ফুটবল খেলছে। তারা আবার প্রতিযোগিতা করে পরনের কাপড় হাঁটুতে তুলে নদী পাড় হচ্ছে। নদীতে পানি নেই দৃশ্য দেখে হুহু করে ওঠে মন। সর্বনাশা তিস্তা এখন রবী ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ পর্যায়েও নেই। হাঁটতে হাঁটতে রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা নদীর চরে পিঁয়াজের চারায় রোপণরত দুই ক্ষেতমজুর তুহিন আর সেরাজুলের সঙ্গে কথা হয়। তাদের বক্তব্য এমন, ‘এরশাদ হামাক মফিজ পাইচে। ভোলেয়া ভালেয়া ভোট নিয়ে ত্যাই বিক্রী করে দেন। হামরা আর এরশাদের মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলবার নই। এবার ভোটে লাঙ্গলক এবার মুলা দেকামো।’ কুড়িগ্রামের রাজার হাট, তিস্তা রেলওয়ে জংশন, উলিপুর, কাঠালবাড়ি এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের কথায় মনে হলো তারা নিজেদের ওপর ক্ষুব্ধ। এরশাদের ওপর বিরক্ত। তরফদার নামের এক চা বিক্রেতার কথায় সেটা ফুটে উঠলো। বললো ’৯০-এর পর লাঙ্গলে ভোট দিয়ে ভুল করেছি। নৌকা বা ধানের শীষে ভোট দিলে এলাকার উন্নতি হতো। লাঙ্গলে ভোট দিয়ে আমরা এরশাদের উন্নতি করেছি। তার স্ত্রী, ভাই-বোন-ভাতিজা দুলাভাইকে নেতা বানিয়েছি; অথচ আমাদের কিছুই হয়নি। বেদে-সাপুড়িয়াদের মতো সকাল-বিকেল কথা বদল করে এরশাদ ঐতিহ্যবাহী রংপুরের মানুষের মানইজ্জত নষ্ট করছেন। কয়দিন আগে এরশাদ কইলো ‘মুই নিব্বাচন (নির্বাচন) করো নাই’। ‘হামার কথা হলো- নিব্বাচন (নির্বাচন) না করলে এমপি হলু কেমন করি? প্রধানমন্ত্রীর দূত হয়া পতাকা উড়াইস কেমন করি? হামাকগুলাক মফিজ পাচিস?’ বোঝা গেল সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের ওপর এ এলাকার মানুষ প্রচ- বিক্ষুব্ধ। ১৫ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় রংপুর শহরের মর্ডান মোড়ের (অনতিদূরে এরশাদের বাড়ি) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মানিক লাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এরশাদ তার বউকে (স্ত্রী) ভাংগা ইলেকশনে (২০০৯ সালের উপ-নির্বাচনে) এমপি করিল। ৫ বছরে ওই মহিলা ২ বার অম্পুরত (রংপুর) আইলো। মানুষকে কিছু দিল না। অম্পুরের কথা শুনলে তার খালিবোলে অসুখ হয়। ত্যাই (সেই) এবার জামাইক ল্যাং মেরে বিরোধী দল নেতা হইলো। এখন শুনি তার সাথে এরশাদের ক্যাচাল। জাগার ছাওয়াল হওয়ায় এরশাদক ভোট দিছনো ফাঁসি থাকি বাঁচার জন্য। উয়ার বউ-ভাই-ভাতিজাকে এমপি করার ভোট দেই নাই। উপজেলা নির্বাচনত এবার বুঝবে ঠ্যালা।’ নব্দীগঞ্জের এক স্কুল শিক্ষক জানালেন, তিনি জাতীয় পার্টি করতেন। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় থেকে দল ত্যাগ করেছেন। তার ভাষায় ওই প্রকৃতির ব্যক্তির নেতৃত্বে দল করলে পরিবারের সদস্যরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে।
রংপুর বিভাগের ৯ জেলার মধ্যে ৮ জেলা ঘুরে বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কয়েকদিন কথা বলে প্রায় অভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে।
- See more at: http://www.dailyinqilab.com/2014/02/22/162627.php#sthash.76Lpg2QN.dpuf
এরশাদ : একজন সাপুড়ে রাজনীতিক!
ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা : ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রথমে নিজ নির্বাচনী এলাকা রংপুর সফরে এসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ বলেছেন, ‘আমি এখনো শৃংখলমুক্ত রাজনীতিবিদ নই, অতীতেও শৃংখলমুক্ত ছিলাম না; এখনো নই।’ এরশাদের এ বক্তব্য রংপুরের মানুষের মধ্যে বেশ হাসির খোরাক জুগিয়েছে। রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ আর দলনে যারা হাসতে ভুলে গিয়েছিলেন তারাও এরশাদের এ বক্তব্য শুনে না হেসে পারেননি। অনেকেই এধরনের হাসানোর খোরাকের যোগান দেয়ায় এরশাদের প্রশংসা করছেন।
এরশাদের রংপুর সফরের আগের দিন জাতীয় পার্টির জেলা কার্যালয়ের অনতিদূরে পায়রা চত্বরে দাঁড়িয়ে এক সরকারি চাকুরে রংপুরে জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এরশাদের রাজনৈতিক আচরণ হলো সাপুড়েদের মতোই। সাপুড়েরা যেমন সাপের খেলা দেখানোর সময় কথা দিয়ে মানুষ ভুলিয়ে-ভালিয়ে টাকা রোজগার করে; তেমনি এরশাদও কথার ছলনে রংপুরের মানুষকে ভোলাতে চেষ্টা করেন। আনপ্রেডিক্টেবল খ্যাত এরশাদ সকালে এক কথা আর বিকেলে আরেক কথা বলায় মানুষ তার কথা আস্থায় নেয় না। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং ৫ জানুয়ারীর জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে ভেল্কিবাজী করেছেন তার খেসারত তাকে দিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সিএমএইচ-এ থেকে তিনি কখনো দাবি করেন আমি আটক, আবার গলফও খেলেন নিয়মিত। তার দলের লোকজনই গলফ খেলার দৃশ্য মোবাইলে ধারন করে তা মিডিয়ায় সরবরাহ করেছে। সেই ব্যক্তিরাই এখনো তার রাজনৈতিক সঙ্গী। এরশাদ মুখে যাই বলুক মানুষ তাকে আস্থায় নেয় না। আলোচনায় যোগ দিয়ে একজন অধ্যাপক বললেন, ওই লোকের কাছে রংপুরের মানুষ যেন ভোট বন্ধক রেখেছে। আর উনি ইচ্ছামতো যেমন খুশি তেমন ভোট বিক্রী করছেন। রংপুরের মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে তিনি দুই ভাই, স্ত্রী, বোন, ভাতিজা, বোন জামাইকে এমপি, মন্ত্রী করেছেন। তিনি আর সে সুযোগ পাবেন না। উপজেলা নির্বাচনে এরশাদ টের পাবেন রংপুরের জনগণের কাছে তার অবস্থান কোথায়। তার ভেল্কিবাজীতে মানুষ আর ভুলবে না।
রংপুর শহরের পায়রা চত্বরে স্থানীয় কলেজের অধ্যাপকের ক্রোধের প্রতিফলন দেখা গেছে এবার উপজেলা নির্বাচনে। প্রথম দফায় ৯৭ উপজেলা নির্বাচনে ৯৬টির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ৪৩টি, আওয়ামী লীগ ৩৪টি, জামায়াত ১৩টিতে বিজয়ী হয়েছে। আর এরশাদের জাতীয় পার্টি মাত্র একটি উপজেলায় বিজয়ী হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান পদেও একই অবস্থা। ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ৩২ (পুরুষ) ৩৪ (নারী), আওয়ামী লীগ ২৪ (পুরুষ) ৩৪ (নারী), জামায়াত ২৩ (পুরুষ) ১০ (নারী), জাতীয় পার্টি ৩ (পুুরুষ) ১ (নারী) বিজয়ী হয়েছে। জামায়াত আর জাতীয় পার্টির ফলাফলের চিত্রই বলে দেয় দেশের রাজনীতিতে এরশাদের অবস্থান কোথায়।
রংপুরের কয়েকটি উপজেলার গ্রামগঞ্জ এবং জেলা শহরে ঘুরে কৃষক ক্ষেতমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন মত পথ ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যারা এরশাদকে নিয়ে এতোদিন গর্ব করতেন; তারাই দুঃখ করছেন; নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আফসোস করছেন। বিগত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এরশাদের মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেয়ার জন্য নিজেদের ধিক্কার দিচ্ছেন। গাইবান্ধার স্টেশন রোডে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী রওশন আলম আকন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজনীতিতে আদর্শ থাকে; থাকে নীতি নৈতিকতা। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলোর নেতাদের অনৈতিকতা করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলো এরশাদের মতো রঙ্গিন নেতারা ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ প্রবচন চালু করে মূল্যবোধের রাজনীতিতে শেষ পেরেক ঠুঁকে দিয়েছেন। নীতি নৈতিকতার চেয়ে ক্ষমতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় ওরা জনগণের সঙ্গে এমন আচরণ করছেন। রংপুরের মানুষের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে এরশাদ এতোদিন জনপ্রিয়তার পারদ উপরে উঠিয়েছেন; কিন্তু তার নীতিহীনতা আর জামা-কাপড় বদলের মতো ‘ক্ষণে ক্ষণে মত বদল’ রংপুরের মানুুষের ভুল ভেঙ্গে দিয়েছে। গাইবান্ধায় দেখা গেল বিগত জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পোস্টারে এরশাদের ছবিতে কে বা কারা কালি লেপ্টে দিয়েছে। জামায়াত অধ্যুষিত সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়ও একই চিত্র দেখা গেল। বেরসিকদের কেউ কেউ আবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও দলের চেয়ারম্যানের ছবিতে কালো কালি দিয়ে গোঁফ এঁকে দিয়েছেন। দৃষ্টিকটূ ওই পোস্টারগুলো বাতাসে উড়ছে পত্ পত্ করে।
তিস্তা স্টেশনে নেমে পিছনের পথে কিছুদূর এলেই তিস্তার চর। কাউনিয়া রেলওয়ে ব্রীজ আর অনতিদূরে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করা নতুন ব্রিজ। ব্রিজের নীচে পানি নেই। স্কুল আর মাদ্রাসার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কয়েকজন ছেলে ফুটবল খেলছে। তারা আবার প্রতিযোগিতা করে পরনের কাপড় হাঁটুতে তুলে নদী পাড় হচ্ছে। নদীতে পানি নেই দৃশ্য দেখে হুহু করে ওঠে মন। সর্বনাশা তিস্তা এখন রবী ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ পর্যায়েও নেই। হাঁটতে হাঁটতে রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা নদীর চরে পিঁয়াজের চারায় রোপণরত দুই ক্ষেতমজুর তুহিন আর সেরাজুলের সঙ্গে কথা হয়। তাদের বক্তব্য এমন, ‘এরশাদ হামাক মফিজ পাইচে। ভোলেয়া ভালেয়া ভোট নিয়ে ত্যাই বিক্রী করে দেন। হামরা আর এরশাদের মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলবার নই। এবার ভোটে লাঙ্গলক এবার মুলা দেকামো।’ কুড়িগ্রামের রাজার হাট, তিস্তা রেলওয়ে জংশন, উলিপুর, কাঠালবাড়ি এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের কথায় মনে হলো তারা নিজেদের ওপর ক্ষুব্ধ। এরশাদের ওপর বিরক্ত। তরফদার নামের এক চা বিক্রেতার কথায় সেটা ফুটে উঠলো। বললো ’৯০-এর পর লাঙ্গলে ভোট দিয়ে ভুল করেছি। নৌকা বা ধানের শীষে ভোট দিলে এলাকার উন্নতি হতো। লাঙ্গলে ভোট দিয়ে আমরা এরশাদের উন্নতি করেছি। তার স্ত্রী, ভাই-বোন-ভাতিজা দুলাভাইকে নেতা বানিয়েছি; অথচ আমাদের কিছুই হয়নি। বেদে-সাপুড়িয়াদের মতো সকাল-বিকেল কথা বদল করে এরশাদ ঐতিহ্যবাহী রংপুরের মানুষের মানইজ্জত নষ্ট করছেন। কয়দিন আগে এরশাদ কইলো ‘মুই নিব্বাচন (নির্বাচন) করো নাই’। ‘হামার কথা হলো- নিব্বাচন (নির্বাচন) না করলে এমপি হলু কেমন করি? প্রধানমন্ত্রীর দূত হয়া পতাকা উড়াইস কেমন করি? হামাকগুলাক মফিজ পাচিস?’ বোঝা গেল সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের ওপর এ এলাকার মানুষ প্রচ- বিক্ষুব্ধ। ১৫ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় রংপুর শহরের মর্ডান মোড়ের (অনতিদূরে এরশাদের বাড়ি) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মানিক লাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এরশাদ তার বউকে (স্ত্রী) ভাংগা ইলেকশনে (২০০৯ সালের উপ-নির্বাচনে) এমপি করিল। ৫ বছরে ওই মহিলা ২ বার অম্পুরত (রংপুর) আইলো। মানুষকে কিছু দিল না। অম্পুরের কথা শুনলে তার খালিবোলে অসুখ হয়। ত্যাই (সেই) এবার জামাইক ল্যাং মেরে বিরোধী দল নেতা হইলো। এখন শুনি তার সাথে এরশাদের ক্যাচাল। জাগার ছাওয়াল হওয়ায় এরশাদক ভোট দিছনো ফাঁসি থাকি বাঁচার জন্য। উয়ার বউ-ভাই-ভাতিজাকে এমপি করার ভোট দেই নাই। উপজেলা নির্বাচনত এবার বুঝবে ঠ্যালা।’ নব্দীগঞ্জের এক স্কুল শিক্ষক জানালেন, তিনি জাতীয় পার্টি করতেন। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় থেকে দল ত্যাগ করেছেন। তার ভাষায় ওই প্রকৃতির ব্যক্তির নেতৃত্বে দল করলে পরিবারের সদস্যরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে।
রংপুর বিভাগের ৯ জেলার মধ্যে ৮ জেলা ঘুরে বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কয়েকদিন কথা বলে প্রায় অভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে।
- See more at: http://www.dailyinqilab.com/2014/02/22/162627.php#sthash.76Lpg2QN.dpuf

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন